ঢাকা, রবিবার   ২৮ এপ্রিল ২০২৪

নারীর ক্ষমতায়নের বড় বাধা নির্যাতন ও সহিংসতা

প্রকাশিত : ১৫:১৬, ৮ মার্চ ২০১৯

সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক সীমানা ব্যতিরেকে নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে সারাবিশ্বেই প্রায় একই বাস্তবতা বিরাজ করছে। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো আমাদের দেশেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা তথা পুরুষের কর্তৃত্ব, নারীর প্রতি বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ক্ষতিকারক অনুশীলনগুলোর সামাজিক বৈধতা এবং অপর্যাপ্ত আইনি সুরক্ষা বা বিচারহীনতার সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন কারণে নারী ও মেয়েশিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আর তাই নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা, অনুমোদিত সংবিধান, সিডও সনদসহ বিভিন্ন চুক্তিতে স্বাক্ষর, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ও এই নীতিমালা বাস্তবায়নে গৃহীত কর্মপরিকল্পনা নারীর সমান অধিকার সুরক্ষার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন অর্জনে সহায়তা করছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা একই লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করছে।

এ বছরের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- ‘সবাই মিলে ভাবো, নতুন কিছু করো, নারী-পুরুষ সমতার নতুন বিশ্ব গড়ো’। সমাজ ও দেশের যে চিত্র আমরা পাই, সে অনুযায়ী নারী নির্যাতন মাত্রা এবং এর ব্যাপকতা ক্রমাগত বাড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নির্যাতনের নৃশংসতম বীভৎসতা।

ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচি (সিইপি) দরিদ্র ও অধিকারবঞ্চিত নারীর সচেতনতা বৃদ্ধি করে তাদের অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করে, যা টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনার (এসজিডি-৫) সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, যেখানে জেন্ডার সমতা অর্জন করে সব নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি, এসডিজির ১৬তম লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিকরণ সমাজ গঠনে সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি সহিংসতামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

নারীর ক্ষমতায়নের পথে অন্যতম বাধা হলো নির্যাতন ও সহিংসতা। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ব্যাপকতা, সহিংসতার ধরন জানার মাধ্যম সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে সংস্থার নিজস্ব উদ্যোগ এবং অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে কার্যকর লিংকেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সিইপি একটি অনলাইন ডাটাবেস পরিচালনা করে। সংগৃহীত তথ্যে বিশ্নেষণের জন্য কেন্দ্রীয় ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) প্রস্তাবিত একটি সাধারণ বিন্যাস ব্যবহার করে সিইপি কর্তৃক পরিচালিত কর্মএলাকার ৫৬ জেলার ৩৭৯ উপজেলার অধীনে ১২৮০০ পল্লী সমাজ কর্তৃক সংগৃহীত ওয়ার্ড থেকে সংঘটিত সহিংস ঘটনাগুলোর তথ্য বিশ্নেষণ করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ১২২৬৫টি ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ১৫ শতাংশ মেয়েশিশু এবং ৮৫ শতাংশ নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৬৮ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন, ৯ শতাংশ মানসিক নির্যাতন, ৬ শতাংশ আত্মহত্যা, ৪ শতাংশ ধর্ষণ এবং ২ শতাংশ নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সহিংসতার মূল কারণ অনুসন্ধানে ৫৮ শতাংশ সহিংসতা ঘটেছে যৌতুক এবং পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে, যার সূত্রপাত আবার বাল্যবিয়ের মতো ক্ষতিকারক সামাজিক অনুশীলন থেকে। প্রাপ্ত তথ্য আরও নির্দেশ করে যে, ভুক্তভোগীর মধ্যে ১২ শতাংশই মেয়েশিশু, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে, ৭৫ শতাংশ নারীর বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে এবং বাকি ১৩ শতাংশ নারীর বয়স ৩৫ বছরের ওপরে। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ করে উদ্বেগজনক যে তথ্য পাওয়া যায় তা হলো, ৯১ শতাংশ নারী ঘরেই নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতনকারীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই পরিবারের সদস্য, যার মধ্যে ৬৫ শতাংশ নারী স্বামী দ্বারা এবং ২ শতাংশ নারী স্বামীর পরিবারের সদস্য এবং বাকি ৮ শতাংশ নারী নিজ পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

সিইপির প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঘরে ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই নারী অনেক বেশি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বেড়ে ওঠে। নির্যাতনের ফলে ব্যক্তি নারীর শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতনের পাশাপশি গোটা পরিবারই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বেশিরভাগ নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিরূপ প্রভাব পরিবারের অন্য সদস্য, বিশেষ করে ছোট শিশুদের ওপর পড়ে। যার ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর নির্যাতনের দুষ্টচক্র গড়ে ওঠে। তাই নির্যাতন প্রতিরোধে পরিবার থেকেই নারী-পুরুষের দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।

আর তাই নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা দরকার। সন্তানদের শিশুকাল থেকেই এভাবে গড়ে তোলা, যেন তার মধ্যে নারীর প্রতি অবমাননাকর কোনো ধারণা তৈরি না হয়, নারীকে ভোগ্যপণ্য মনে না করে, পাশাপাশি প্রতিটি শিশুসন্তানকে ছেলেমেয়ে বিভেদ না করে লেখাপড়াসহ সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। খেলাধুলা, খাবার গ্রহণ, ঘরের কাজ, বাইরের কাজ, স্কুলে যাওয়া ইত্যাদি কোনো ক্ষেত্রেই ছেলেমেয়ের মধ্যে বিভেদ না করা। নারী ও পুরুষকে সমভাবে নির্যাতন প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে হবে।

এ বছরের মূল প্রতিপাদ্য অনুযায়ী সবাই মিলে নতুন কিছু করতে হলে আমাদের প্রত্যেকের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে নিজ নিজ পরিবারকে নির্যাতন ও বৈষম্যমুক্ত করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পুরুষ ও যুবদের সম্পৃক্তকরণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে পরিবার ও সমাজকে নারীর নিরাপদ স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এভাবে প্রতিটি পরিবারকে যদি আমরা নির্যাতনমুক্ত করতে পারি, তাহলে গোটা সমাজ এবং দেশ থেকে আমরা নির্যাতনের বিভীষিকা থেকে নারীকে মুক্ত করতে পারব। আমরা পারব সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নেওয়ার যাবতীয় সৃষ্টিশীল উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নারীকে আরও কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করতে।
লেখক : পরিচালক, সামাজিক ক্ষমতায়ন, জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি এবং সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচি, ব্র্যাক
এসএ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি